অধ্যক্ষ রুহুল আমিন
সাহিত্যের ভ্রমণ পরিষদের সাধারণ সম্পাদক জনাব অনুপম ইসলামের সংগে গল্প সংখ্যা ঘাসফুল নিয়ে সেপ্টেম্বর’১৬ প্রথম সপ্তাহে আলোচনা হচ্ছিল। আলোচনার এক পর্যায়ে তিনি বলেন আবুল হুসাইন জাহাঙ্গীর তার রচিত গ্রন্থসমূহ নিয়ে কাজ করার জন্য তাকে অনুরোধ করেছেন। তিনি আমার কাছে জানতে চাইলেন আমি আ’হুজার কোন গ্রন্থ নিয়ে কাজ করতে চাই কিনা? ইতিপূর্বে আমি আহুজার “ডহরী” উপন্যাস নিয়ে কাজ করেছি। আমি তাকে বলেছিলাম সময় সুযোগ হলে চেষ্টা করে দেখব। প্রায় সপ্তাহ খানেক পর ঠিক করলাম কষ্ট করে হলেও কাজটি আমি করতে চাই। কারণ মাস তিনেক আগে জাহাঙ্গীর ভাই আমাকে “সুন্দর বনের লোকজীবন” বইটি আমার কাছে পাঠান। ঠিক করলাম এই বইটির উপরই কাজ করব। আমার সিদ্ধান্তটা ফোন করে রফিক ভাইকে জানাতেই তিনি খুশি হলেন। বইটি আমার বই এর আলমারিতে ছিল। পড়ার উদ্দেশ্যে বইটি বের করলাম।
সুন্দর অফসেট কাগজে ছাপানো বইটি। প্রচ্ছদ বরাবরের ন্যায় চারুপিটুর করা। প্রচ্ছদের উপরিভাগে বৃক্ষরাজির নিচে জনা চারেক পুরুষ, দু’জন মহিলা ও এক পাশে বাচ্চা কোলে দাড়িয়ে থাকা এক মহিলাকে একটি মেয়ে একখানা পুস্তক সাদৃশ্য মেলে ধরে শ্রোতা-দর্শকদের উদ্দেশ্যে কিছু একটা বোঝানোর চেষ্টা করছেন। কভার পেজটি অবসেটের পুরু কাগজের উপর রঙ্গিন ছবিটি দারুন দেখাচ্ছে। ১১২ পৃষ্ঠার বইটি দুই খণ্ডে বিভক্ত। প্রথম খণ্ডটি ৮৮ পৃষ্ঠা পর্যন্ত বিস্তৃত। দ্বিতীয় খণ্ডটি মাত্র ২৪ পৃষ্ঠায় শেষ হয়েছে। প্রথম খণ্ড ২২টি পর্বে এবং দ্বিতীয় খণ্ড পাঁচটি পর্বে বিভক্ত। উপন্যাসটির প্রকাশ কাল বই মেলা ২০১৫। বই-এর স্বত্ব সংরক্ষিত লেখক দ্বারা। ঢাকার শাহবাগের ৪৭ আজিজ মার্কেটের নিচতলা পলক প্রকাশনী উপন্যাসটি প্রকাশ করেছেন। বইটির মুদ্রণ হয়েছে ঢাকার নিউ মার্কেটের অপরপারে ১৪৭-১৪৮ গাউছুল আজম সুপার মার্কেটের ফাগুন এ্যাডভাটাইজিং থেকে। উপন্যাসটির মূল্যমান রাখা হয়েছে ১৫০ টাকা। সুন্দর অপসেটে ছাপানো উপন্যাসটির ধার্যকৃত মূল্যমান যথার্থই নির্ধারণ করা হয়েছে বলে আমার মনে হয়েছে।
বইটি উৎসর্গ করা হয়েছে লেখকের নিজ আবাসিক এলাকা তথা ঝাঁপা বাওড় এলাকার বিশিষ্ঠ শিক্ষাবিদ লেখকের বন্ধুবর যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. মোঃ আব্দুস সাত্তার ও তাঁর সুযোগ্যা সহধর্মিণী জনাবা মিসেস নাছিমা আখতার (জুঁই) দম্পতিকে। লেখক এবং এই বরেণ্য শিক্ষাবিদ ঝাঁপা বাওড়ের পাশের মানুষ। এদের জীবনের বিরাট অংশ জুড়ে আছে ঝাঁপা বাওড়ের প্রভাব। এ অঞ্চল আমারও খুব ভাল লাগে। আমার ভাল লাগার একটা কারণ হল ২০১৪ সালের মে মাসে সাহিত্যের ভ্রমণ পরিষদ কর্তৃক “ঝাঁপা” পত্রিকা প্রকাশিত হয়। ঐ পত্রিকার মূল প্রবন্ধ লিখতে আমাকে দায়িত্ব দেওয়ায় লেখার প্রয়োজনে আমাকে কয়েকবার ঝাঁপা বাওড়ের চার পাশের গ্রামগুলোতে তথ্য সংগ্রহের জন্য যেতে হয়েছে। ঐ পত্রিকায় লেখা আমার প্রবন্ধের শিরোনাম ছিল “ঝাঁপা জনপদের ইতিকথা”। তথ্য সংগ্রহের সময় ঝাঁপা বাওড় ও তার চার পাশের গ্রামগুলোর যে মনোরম প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখেছি তা আমাকে মুগ্ধ করেছে। উপন্যাসটি উৎসর্গের ব্যাপারে লেখক যে ব্যক্তিদ্বয়কে বেছে নিয়েছেন, আমার মতে লেখকের সিদ্ধান্তটা ছিল যথার্থ।
উৎসর্গ পাতার পরবর্তী পাতায় লেখক পূর্বাভাস লিখেছেন। সেখানে “সিডর, আইলা ও নার্গিসের” মত মহা-সাইক্লোনে সমুদ্র উপকূলবাসির উপর দিয়ে যে ভয়াবহ ও করুণ পরিনতি বয়ে যায় তার একটা প্রাথমিক ও স্বচ্ছ ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। ফলে উল্লেখিত সাইক্লোন সম্পর্কে সম্যক ধারণা না থাকা পাঠকের জন্য উপন্যাস পাঠের পূর্বেই প্রাথমিক ধারণা নিয়ে পাঠের বিষয় সহজেই হৃদয়ঙ্গম করার ক্ষেত্রে সাহায্যে করবে। পাশা-পাশি বন্যা ও সাইক্লোনের সময় ঐ এলাকার নদী ও গ্রাম গুলোর নাম উল্লেখ করে পাঠককে গ্রাম ও নদী সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। পাশাপাশি এই অংশে লেখককে বাস্তবতা উপলব্ধি করতে যেসব মানুষ সহায়তা করেছেন তাদের নাম উল্লেখ করে তাদের কৃতজ্ঞতা পাশে আবদ্ধ করে লেখক বড় মনের পরিচয় দিয়েছেন। মুখবন্ধে লেখক সমুদ্র উপকূলীয় অংশে বসবাসকারী ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির মানুষ আদিবাসি ও নিম্নবর্ণের মানুষের বর্ণনা দিতে গিয়ে প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে শুরু করে কোল, দ্রাবিড়, আর্য, তুর্কি, মুঘল, বৃটিশ, জমিদার, সামান্তপ্রভু থেকে আজ পর্যন্ত এখানে বসবাসকারী মানুষদের আদি বাসস্থান ছেড়ে দুর্গম এলাকায় এসে বসবাস করার সংক্ষিপ্ত পূর্বকথা তুলে ধরে ইতিহাসের প্রতি সম্মান দেখিয়েছেন। লেখকের নিরলস কষ্ঠার্জিত সত্য উৎঘটনে তার প্রচেষ্ঠা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবী রাখে।
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চল তথা যশোর-খুলনা অঞ্চল এক সময় সুন্দরবনের অংশ ছিল। আজও কেশবপুর-মণিরামপুর অঞ্চলের মাটি ১০/১৫ ফুট খুঁড়লেই মাটির নিচে বড়-বড় গাছের গুড়ি পাওয়া যায়। এ ছাড়া কোন কোন এলাকায় বাঘসহ অন্যান্য জীব-জানোয়ারের কঙ্কালও পাওয়া গেছে। সুন্দরবন ক্রমান্বয় দক্ষিণ দিকে সরে যাচ্ছে। অতীতে সুন্দরবন অঞ্চল আবাদ করার জন্য ভারতের বিহার রাজ্যের রাঁচি ও ছোট নাগপুর থেকে সাহসী, কর্মঠ, সৎ ও পরিশ্রমী ব্যক্তিদের নিয়ে আসেন তৎকালিন শাসকশ্রেণী ও তার সহযোগীরা। এরা হল মুণ্ডা সম্প্রদায়। একটি তথ্য থেকে জানা যায় মুণ্ডা সম্প্রদায়ের যে ব্যক্তি এদেশে আসেন তার নাম ‘পাগল সরদার’। তারপর ছোট ছোট দলে এরা এসে দেশের সুন্দরবনসহ বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। এদের জীবন আচার-অনুষ্ঠান সামাজিক, প্রশাসনিক, সাংষ্কৃতিক ও ধর্মীয় জীবনের পাশাপাশি এ দেশের দরিদ্র মুসলমান ও শুদ্র শ্রেণী নিয়ে আবুল হুসাইন জাহাঙ্গির “সুন্দরবনের লোকজীবন” উপন্যাস রচনা করেছেন।
সুন্দরবনের লোকজীবন উপন্যাসে তৃতীয় অধ্যায়ে ঔপন্যাসিক কয়েকটি বাক্যে যে মন্তব্য করেছেন তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেখানে তিনি বলেছেন, “চারিদিকে নদী ও বন। গভীর সমুদ্র ও গহীন অরণ্য। গাবুরা জোড়াশিং আংটিহারা বাংলাদেশের দক্ষিণের শেষ জনপদ। এরপর তেপান্তরের মাঠ নেই, জনপদ নেই। শহর, গ্রাম, হাটবাজার নেই। কিন্তু মানুষ আছে। হিন্দু মুসলিম ও পৃথক জাতিসত্তার কর্মঠ কর্মজীবী মানুষ জন। যাদের জীবন-জীবিকা নদী ও বন নির্ভর। এখানে যে মানুষগুলো বাস করে তাদেরকে এই সব গ্রামের সন্তান না বলে প্রকৃতির সন্তান বলাই ভালো।” এই অংশে লেখক কোন সুনির্দিষ্ট জাতি বা গোষ্ঠীর কথা না বলে সমগ্র সুন্দরবন অঞ্চলে বসবাসকারী হিন্দু-মুসলিম, রাজবংশী, মুণ্ডা, ক্ষত্রিয়, শূদ্র, বুনো ও বগদি প্রভৃতি সম্প্রদায়ের পরিশ্রমী মানুষের কথা বলেছেন।
এই গ্রন্থে লেখক মুণ্ডা সম্প্রদায়ের বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক,পালা-পার্বন ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানের রীতিনীতি-আচার অনুষ্ঠানের খুটিনাটি বিষয়গুলি সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। পাশাপাশি প্রয়োজনে অন্য গোষ্ঠী বা সম্পদায়ের কথাও তিনি তুলে ধরেছেন। সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয় অতি সুন্দর ভাবে তুলে আনা লেখকের একটা বড় গুন। যেটা লেখক আবুল হুসাইন জাহাঙ্গীরের ভিতর বরাবরই লক্ষ্য করা যায়। পাশাপাশি বিভিন্ন আঞ্চলিকতায় অনেক কথ্য ভাষাও তিনি সাবলিলভাবে ব্যবহার করেন। তিনি মেস্কিকিয়ান পাদ্রীর ফাদার লুইজি পাজ্জী এস এক্স- কে তার দুই যুগেরও অধিক বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে অনগ্রসর ও পিছিয়ে পড়া শ্রেণীর মানুষের জন্য যে অক্লান্ত পরিশ্রম করে কাজ করে যাচ্ছেন তার স্বীকৃতি এই গ্রন্থে দিয়ে গ্রন্থটির মর্যাদা বৃদ্ধি করেছেন। এই সুযোগে আমিও ঐ মহান ব্যক্তিকে ধন্যবাদ ও শুভকামনা জানাচ্ছি। প্রায় ২৪/২৫ বছর পূর্বে তার চুকনগর অবস্থান কালীন সময়ে বার দুয়েক তার সংগে আমার সাক্ষাৎ হয়েছে। হাজার হাজার মানুষের ভীড়ে তার হয়তো আমাকে মনে নেই; কিন্তু আমি তাকে শ্রদ্ধার সংগে মনে রেখেছি। তার শারীরিক ও মানুষিক সুস্থতার পাশাপাশি দীর্ঘ জীবন কামনা করছি।
লেখক এই গ্রন্থের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠানে কারণে-অকারণে হাঁড়িয়া মদের প্রসঙ্গ এনেছেন। একই অনুষ্ঠানের বর্ণনা একাধিক জায়গায় একাধিক বার ব্যবহার করে বই-এর কলেবর বৃদ্ধির প্রয়াস লক্ষনীয়। প্রবাদ আছে-‘চালে কাঁকর আর সাহিত্যে নগ্নতা থাকলে তা সহজেই বিকোয়।’ মনে হয় লেখক এই প্রবাদটা জানেন। তাই তিনি মাঝে মাঝে আদিরসে কোথাও কোথাও সিক্ত করেছেন। যেমন-১৩ অধ্যায়ের শেষাংশে “জয়মনি ধনিয়ার দেয়া অঙ্গাবরণ অন্ধকারে খুলে জয়কৃষ্ণকে কাছে টেনে নিল। জয়কৃষ্ণ আঠার মত জয়মণির শরীরের সংগে লেগে রইল। ওয়াগানটা একটু একটু করে কাঁপতে লাগল। … …….. জয়কৃষ্ণ হাঁফাতে লাগলো। জয়মনি বললো, উঠো না। আর একটু থাকো।…………….ওয়াগনের মধ্যে ভূতুড়ে অন্ধকারে জয়কৃষ্ণ মুণ্ডা ও জয়মনি মুণ্ডা নিজেদের পরিধেয় বস্ত্র খুঁজতে থাকে।” এরপর ১৬” অধ্যায়ে লিখেছেন “রাতে রামকৃষ্ণ লক্ষ্মীকান্ত ও সীতা একসঙ্গে হাঁড়িয়া মদ টেনে আকণ্ঠ নিমজ্জিত হয়েছিল নেশার ঘোরে। লক্ষ্মীকান্ত বিভোর হয়ে ঘুমিয়ে নাক ডাকছে। হুঁশ জ্ঞান নেই। প্রায় সারারাত লক্ষ্মীকান্তর বাহুডোর বিছিন্ন সীতারানী মুণ্ডা রামকৃষ্ণের সঙ্গে আদি ক্রীড়ায় মত্ত হয়ে রতি বিলাসে মগ্ন ছিল। নেশামগ্ন ঢুলু ঢুলু নয়নে অবিশ্রান্ত রতিবিলাসে কান্ত সীতারানী মুণ্ডা বিস্রস্ত বেশবাসে আলুলায়িত চুলে সিঁদুর লেপটানো কপালে ঢুলে ঢুলে পড়ে।” এখানে সীতারনী মুণ্ডা ও রামকৃষ্ণ মুণ্ডার উলঙ্গ পরকীয়ার রূপ ফুটে উঠেছে। একই অধ্যয়ের ৬৫ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে- “সতীচ্ছদ পর্দা ছিড়ে সেই আদিম প্রবৃত্তির কালে রক্তের স্রোত ধারা নেমেছিল যোনিদ্বার দিয়ে তবুও রামকৃষ্ণ ছাড়েনি। একই রাতে হাঁড়িয়া মদের নেশার প্রাচুর্যে রামকৃষ্ণ জ্ঞান গরিমা ভুলে অবিরাম ধর্ষণ করেছিল বালিকা বধুকে”। ‘১৮’ অধ্যায়ে তিনি লিখেছেন- “জয়কৃষ্ণ ময়দার মত ছেনে চলেছে জয়মনির স্তনযুগল-দুমড়াচ্ছে মোচড়াচ্ছ।” এ ছাড়াও অনেক স্থানে তিনি সচেতন ভাবে আদি রসের প্রভাব ফেলার চেষ্ঠা করেছেন।
৫৭ পৃষ্ঠায় লেখক বলেছেন ‘ বিবাহপূর্ব যৌন সম্পর্ক মুণ্ডাদের গোষ্ঠীর মধ্যে অঘোষিত ভাবে স্বীকৃত।’-এই কথাটির উপর আমার চোখ আটকে গেল। এটা কোন সভ্য সমাজের কথা নয়। কোন সভ্য সমাজ এটা মেনে নিতে পারে না। যে সমাজে এমন একটি জঘন্য প্রথা প্রচলিত থাকে, তাকে সভ্য সমাজ বলা যাবে না। কথাটি যদি সত্যি হয় তাহলে তো কথাই নেই। সে ক্ষেত্রে আমরা মুণ্ডা সমাজকে কেমন সমাজ বলতে পারি ? তবে এই গ্রন্থে লেখক এই একটি জায়গা ছাড়া অন্য কোথাও এমন কোন কথা বলেননি, যার জন্য মুণ্ডা সমাজকে হেয় ভাবা যায়। আর যদি সত্য না হয় তা হলে আমি বলব এমন একটি উক্তির মাধ্যমে তিনি ঐ সম্প্রদায়কে আহত করেছেন। যেটা কোন লেখকের কাছ থেকে কাম্য নয়। আমি বিষয়টি নিয়ে মুণ্ডা সম্প্রদায়ের বিভিন্ন ব্যক্তির সংগে যোগাযোগ করে তার ঐ বক্তব্যের সত্যতা পায়নি। রথিকান্ত ও কৃষ্ণপদ মুণ্ডার সংগে যোগাযোগ করে জানার চেষ্টা করেছি। কৃষ্ণপদ মুণ্ডা সুন্দরবন আদিবাসি মুণ্ডা সংস্থার পরিচালক। তিনি লেখকের ঐ বক্তব্যের সংগে দ্বিমত পোষণ করেছেন। তাদের মতে এমন বক্তব্য অবিশ্বাস্য। এমন ঘটনার কথা যদি লেখক জেনেও থাকেন, তবে সেটা বিছিন্ন ঘটনা। এমন ঘটনা মুসলমান-হিন্দু-বৌদ্ধ-খৃষ্টান সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রেও ঘটতে শোনা যায়। তার অর্থ কি এই যে ঐ সম্প্রদায়ের সেটা স্বীকৃত! গ্রন্থটিতে লেখকের বড় দুর্বলতা এই যে, লেখক পাঠক টানতে ব্যর্থ হয়েছেন। এই উপন্যাস পাঠ করতে পাঠক ক্লান্ত হয়েছেন। লেখক বিভিন্ন ঘটনার বর্ণনায় জোড়া-তালি দিয়ে দেখানোর চেষ্টার মাধ্যমে গ্রন্থের কলেবর বাড়ানোর চেষ্টা করেছেন।
একটি বিষয় আমার খুব ভাল লাগল। আদিবাসি মুণ্ডা সমাজে “সাগাই” প্রথার মাধ্যমে বিধবারা আবার বিবাহ বন্ধনে আবাদ্ধ হতে পারে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের প্রচেষ্টায় হিন্দু সমাজে বিধবা বিয়ের প্রচলন হলেও অদ্যাবধি হিন্দু সমাজ তা ভালভাবে গ্রহণ করেনি। বর্ণে শ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণ থেকে নিম্ন-বর্ণের শুদ্র শ্রেণী পর্যন্ত অসংখ্য হিন্দু পরিবারে অগণিত বিধবারা বৈধব্যের বলিকাষ্ঠে আত্মহুতি দেয়। বাল্য বিধবারা বিবাহ কি তা বুঝে উঠার আগেই বৈধব্যের সাজে সারাটা জীবন কষ্টে কাটায়। অনেক বিত্তশালী পরিবার সমাজে তাদের সম্মান ও প্রতিপত্তির কথা বিবেচনা করে তাদের পরিবারের বিধবাদের বৃন্দাবন-কাশীধামে তীর্থ ক্ষেত্রে পাঠিয়ে সমাজে তাদের মুখ রক্ষা করেন।
সেখানে হিন্দু সমাজ সাদৃশ্য আদিবাসি মুণ্ডা সমাজ “সাগাই” প্রথার মাধ্যমে বিধবা বিয়ের ব্যবস্থা নিঃসন্দেহে প্রগতিশীল মানুষিকতার পরিচয় বহন করে। এছাড়া সিডর, আয়লার মত প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সময় আশ্রয় কেন্দ্রে হিন্দু- মুসলমানের পাশাপাশি অবস্থান করাকে সামাজিক ক্ষেত্রে যেমন উন্নত মানসিকতার পরিচয় বহন করে । তেমনি বর্তমানেও ব্যাপক হারে বাল্য বিবাহ প্রথা চালু তাদের অজ্ঞতার পরিচয় বহন করে। আবহাওয়ার আগাম ব্যাখা ঐ জনপদে বসবাসকারি জনগোষ্ঠির আবহাওয়ার পূর্বাভাস বিচারের জন্য প্রকৃতির পরিবর্তনের যে বর্ণনা দিয়েছেন তা যুগ যুগ ধরে অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানের পরিচয় বহন করে। এখানে- “ আদিনাথ সকলকে ডেকে বললো, ঝড় হবে তুফান। গোত্র প্রধান রাজকৃষ্ণ গ্রামবাসীদের জানিয়ে দিল আগামবার্তা। আদিনাথ বললো, আকাশের দক্ষিণ দিকে দু’টি বড় তারা থাকে এবং এই তারা দু’টি একই লাইনে অবস্থান করে। যখন এই তারা দু’টি সমন্তরাল অবস্থানে থাকে না তখন বন্যা ও ঝড় হয়। তা ছাড়া আজ দু’দিন হলো ঘরের চালের ওপর ছাগলগুলি লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছে, অতএব নিশ্চিত মিলে যাচ্ছে ঝড় বৃষ্টি বন্যা তুফান এর পূর্বাভাস। চার পাশে লবণ পানি, উষ্ণ বাতাস ,আকাশে দুরন্ত মেঘের ঘনঘটা। বজ্রবিদ্যুৎ। ঐ রাতেই এলো আইলা। ভেসে গেল সুন্দরবনের লোকজীবন…।” এখানে লেখক আদিনাথ মুণ্ডার জবানীতে আবহাওয়ার পূর্বাভাস সম্পর্কে যে বর্ণনা তুলে ধরেছেন, তা যথার্থতা পায়নি বলে আমার মনে হয়।
একুশ অধ্যায়ে লেখক লিখেছেন “পাটকেলঘাটার বেগুনডাড়া গ্রামে ………সেখানে পঞ্চনন মুণ্ডার মেয়ে বন্দনা মুণ্ডা ধর্ষিত হয়েছে। তাকে কৃষ্ণপদ মুণ্ডা শ্যামনগর নিয়ে এলো ক্ষত্রিয় সমাজের এক গৃহস্থবাড়ি কাজের লোক হিসেবে। তাদের বড় বাড়ি। পাল পাল শুয়োর আছে। কৃষ্ণপদ মুণ্ডার সাথে খুব চেনা জানা।” এই অংশে লেখক ক্ষত্রিয় সমাজের মানুষের শুয়োর পালনের কথা বলেছেন। আমার জানা মতে বর্ণ প্রথা অনুযায়ী শুদ্র সমাজের ভিতর কাওড়া সম্প্রদায়ের লোকেরা শুয়োর পালন করে। কোন ক্ষত্রিয় সমাজের লোকেরা শুয়োর পালন করে না।
উপন্যাসের শেষে “উপসংহারে” লেখক মেক্সকিয়ান ধর্মজাযক ফাদার লুইজি পাজ্জি’কে ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বার (নৃ-গোষ্ঠীর) আদিবাসী মানুষ মুণ্ডাদের ত্রাণকর্তা হিসেবে আরও একবার উপস্থাপন করেছেন। “আইলা” ও “সিডরে” বিধ্বস্ত উপকূলবাসিদের লণ্ডভণ্ড জীবনকে পুনঃরায় প্রতিষ্ঠিত করতে, ঠিকানাহীনদের ঠিকানা ফিরিয়ে দিতে, সমাজের মূল স্রোতধারায় তাদেরকে প্রতিষ্ঠিত করতে যে মানুষটি রাত-দিন অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছেন, সেই আলোকিত মানুষটির দ্যুতি ছড়িয়ে তার লেখার সমাপ্তি টেনেছেন। এমন সকল শ্রেণী- পেশার মানুষের কথা বলেছেন। এই গ্রন্থে লেখক ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ও খেটে খাওয়া মানুষের নারী-পুরুষদের জীবন সংগ্রামের যে চিত্র অংকন করেছেন তা নিঃসন্দেহে প্রসংশার দাবী রাখে।
পরিশেষে আমরা বলতে পারি আবুল হুসাইন জাহাঙ্গীর এমন একজন লেখক যিনি সমাজের নিম্নবর্ণ, পিছিয়ে পড়া, ও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষদের কথা বরাবরই ভেবেছেন এবং তার লেখনির মাধ্যমে সেই সকল মানুষদের দৈনন্দিন জীবন, জীবনযাত্রার প্রণালি, আচার অনুষ্ঠান সকলের সামনে তুলে ধরার মাধ্যমে তাদেরকে আলোকিত করার চেষ্টা নিরলস-ভাবে করে যাচ্ছেন। তেমনি একটা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠি সম্প্রদায় হল মুণ্ডা সম্প্রদায়। এই গ্রন্থে লেখক শুধু মুণ্ডা সম্প্রদায়ের কথাই বলেননি; বরং সুন্দরবন অঞ্চলে বসবাসকারী সুন্দরবন ও নদীর উপর জীবন- জীবিকা নির্ভর এমন সকল শ্রেণী- পেশার মানুষের কথা বলেছেন। এই গ্রন্থে লেখক ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ও খেটে খাওয়া মানুষের নারী-পুরুষদের জীবন সংগ্রমের যে চিত্র অংকন করেছেন তা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবী রাখে।
মোঃ রুহুল আমিন
অধ্যক্ষ, পাঁজিয়া ডিগ্রী কলেজ
ডাকঘরঃ পাঁজিয়া, উপজেলাঃ কেশবপুর, জেলাঃ যশোর।
সাংবাদিক ও কলামমিস্ট।
মোবাঃ ০১৭১৮-৬১১৫৫০, ই-মেইলঃ ruhulamin0655@gmail.com
পত্র প্রাপ্তির ঠিকানাঃ
মোঃ রুহুল আমিন (অধ্যক্ষ), গ্রাম- আলতাপোল (অফিস পাড়া), উপজেলা রোড, উপজেলা মসজিদ সংলগ্ন, ডাকঘর- কেশবপুর, জেলা- যশোর।